দেশের আর্থিক খাতে যখন আস্থার সংকট প্রকট, ঠিক তখনই আরও এক দুঃসংবাদ বিনিয়োগকারীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। পাঁচটি ব্যাংকের পর এবার অবসায়নের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে আরও ৯টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এই খবর কেবল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক বা বিনিয়োগকারীদের জন্যই নয়, পুরো আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে।
**ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (NBFI) কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?**
ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (NBFI) বলতে আমরা সাধারণত এমন সব প্রতিষ্ঠানকে বুঝি, যারা ব্যাংকগুলোর মতো সরাসরি আমানত গ্রহণ না করেও ঋণ প্রদান, লিজ ফাইন্যান্সিং, মার্চেন্ট ব্যাংকিং এবং অন্যান্য বিনিয়োগ সংক্রান্ত সেবা দিয়ে থাকে। দেশের অর্থনীতিতে এদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে অর্থায়ন, আবাসন খাতে বিনিয়োগ এবং পুঁজিবাজারে তারল্য প্রবাহ বজায় রাখতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু যখন এমন ৯টি প্রতিষ্ঠান অবসায়নের পথে হাঁটে, তখন তা কেবল তাদের গ্রাহক বা বিনিয়োগকারী নয়, পুরো আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
**আস্থার সংকট এবং বারবার ক্ষতিপূরণের চক্র**
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বিগত বছরগুলোতে দেশের আর্থিক খাতে আস্থার সংকট প্রকট রূপ ধারণ করেছে। এর আগে একাধিকবার পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ফেরাতে এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও, তাতে কাঙ্ক্ষিত সুফল আসেনি। বারবার ক্ষতিপূরণ দিয়েও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো যায়নি, যা এখন নতুন করে ভাবাচ্ছে নীতি নির্ধারকদের।
যেহেতু দেশের পাঁচটি ব্যাংক বন্ধ হওয়ার পর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় এবার এই ৯টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চিন্তা করছে সরকার। যদিও এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি স্বস্তির খবর, তবে এর পেছনে লুকায়িত গভীরতর সমস্যাটি উপেক্ষিত থাকছে না।
**কেন এই সংকট এবং সরকারের ভাবনা?**
এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্দশার পেছনে রয়েছে মূলত অব্যবস্থাপনা, সুশাসনের অভাব, অনিয়ম এবং ঋণ খেলাপিদের দৌরাত্ম্য। খেলাপি ঋণের বোঝা এবং তারল্য সংকটের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না, যার ফলস্বরূপ অবসায়নের মতো কঠিন সিদ্ধান্তে যেতে হচ্ছে।
সরকারের এই উদ্যোগের পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো সাধারণ ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা। যারা নিজেদের স্বল্প পুঁজি দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ করে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন, তাদের একটি ন্যূনতম সুরক্ষা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি, আর্থিক খাতে সম্ভাব্য আরও বড় ধরনের আস্থা সংকট প্রতিরোধ করাও এর একটি লক্ষ্য। তবে, বারবার একই ধরনের সংকট ও তার প্রতিকার হিসেবে ক্ষতিপূরণ প্রদান দীর্ঘমেয়াদে কতটা টেকসই, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
**ভবিষ্যতের পথ ও চ্যালেঞ্জ**
শুধুমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে সমস্যার গভীরে যাওয়া সম্ভব নয়। আর্থিক খাতের এই ধারাবাহিক দুর্বলতা কাটাতে প্রয়োজন কঠোর তদারকি, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা। যে সকল প্রতিষ্ঠান আর্থিক অনিয়ম বা অব্যবস্থাপনার কারণে অবসায়নের পথে হাঁটছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি, বিনিয়োগকারীদেরও আরও সচেতন হতে হবে এবং বিনিয়োগের পূর্বে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা ভালোভাবে যাচাই করে নিতে হবে।
৯টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়ন এবং এর প্রেক্ষিতে ক্ষতিপূরণের চিন্তা নিঃসন্দেহে দেশের আর্থিক খাতের জন্য একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কেবল সাময়িক সমাধান নয়, বরং একটি টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। আশা করি, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে দেশের আর্থিক খাত আগামীতে আরও শক্তিশালী ও স্থিতিশীল হতে পারে।



