## হেবরনের ইব্রাহিমি মসজিদ বন্ধ ঘোষণা, ফিলিস্তিনিদের ওপর কারফিউ আরোপিত: যখন ধর্ম আর অধিকার রুদ্ধ হয়
পবিত্র শহর হেবরন। ফিলিস্তিনের প্রাচীনতম এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন এই শহরটি তার ঐতিহাসিক স্থাপত্য, ঐতিহ্য এবং অবশ্যই সংঘাতের কারণে প্রায়শই বিশ্ব সংবাদ শিরোনামে আসে। যখনই হেবরনের নাম উচ্চারিত হয়, তখনই সেখানে বিরাজমান উত্তেজনা, ধর্মীয় সংবেদনশীলতা এবং দখলদারিত্বের বাস্তবতা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাম্প্রতিক সময়ে, হেবরনের ঐতিহাসিক ইব্রাহিমি মসজিদ বন্ধ ঘোষণা এবং একই সাথে ফিলিস্তিনিদের ওপর কঠোর কারফিউ জারির ঘটনাটি কেবল একটি খবর নয়, এটি ফিলিস্তিনিদের জীবনে এক নিদারুণ কষ্ট, বঞ্চনা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাতের প্রতিচ্ছবি।
### ইব্রাহিমি মসজিদ: মুসলিম ও ইহুদিদের কাছে পবিত্র এক স্থান
ইব্রাহিমি মসজিদ, যা ইহুদিদের কাছে ‘কেভ অফ দ্য প্যাট্রিয়ার্কস’ বা মাকপেলার গুহা নামে পরিচিত, বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এবং ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলির একটি। ইসলাম এবং ইহুদি উভয় ধর্মেই এই স্থানটিকে পবিত্র বলে গণ্য করা হয়। মুসলিমদের বিশ্বাস, এখানে নবী ইব্রাহিম (আ.), ইসহাক (আ.) এবং ইয়াকুব (আ.)-এর মাজার অবস্থিত। একইভাবে, ইহুদিরাও এই স্থানটিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে দেখে। এই সহাবস্থানের ঐতিহ্য দীর্ঘকাল ধরে চলে এলেও, ইসরায়েলি দখলদারিত্ব এবং বিশেষত ১৯৯৪ সালের মর্মান্তিক গণহত্যার পর মসজিদটিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে দেওয়া হয় – একটি অংশ মুসলিমদের জন্য এবং অন্যটি ইহুদিদের জন্য। এর পর থেকেই এই পবিত্র স্থানে প্রবেশাধিকার এবং উপাসনার বিষয়ে তীব্র বিধিনিষেধ ও সংঘাত তৈরি হয়েছে।
### মসজিদ বন্ধ ঘোষণা ও কারফিউর বাস্তবতা
সাম্প্রতিক এই ঘটনায়, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ইব্রাহিমি মসজিদ বন্ধ ঘোষণা করেছে। এর ফলে মুসলিমরা তাদের অন্যতম পবিত্র স্থানে প্রবেশ করে নামাজ আদায় ও ধর্মীয় আচার পালন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর সাথে যোগ হয়েছে হেবরন শহরের ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের ওপর আরোপ করা কঠোর কারফিউ। ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী ও ইহুদি পর্যটকদের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করার অজুহাতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হলেও, এর মূল শিকার হচ্ছেন ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকেরা।
এই কারফিউর অর্থ হলো, ফিলিস্তিনিরা তাদের ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। স্কুল, কলেজ, কর্মস্থলে যাওয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা থেকে শুরু করে সাধারণ চলাফেরাও বন্ধ। এটি শুধু দৈনন্দিন জীবনযাপনকেই প্রভাবিত করে না, বরং এটি তাদের মানবাধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন। এমন সময়ে, যখন উৎসব বা বিশেষ কোনো উপলক্ষ থাকে, তখন এই ধরনের বিধিনিষেধ ধর্মীয় অনুভূতিতে আরও গভীর আঘাত হানে।
### ফিলিস্তিনিদের জীবনে এর প্রভাব
* **ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর আঘাত:** মুসলিমরা তাদের প্রধান উপাসনালয় ইব্রাহিমি মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারছেন না, যা তাদের মৌলিক ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী।
* **দৈনন্দিন জীবন অচল:** কারফিউর কারণে হেবরনের ফিলিস্তিনিদের স্বাভাবিক জীবনযাপন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। শিশু, বয়স্ক, অসুস্থ এবং কর্মজীবী সবাই এর দ্বারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
* **সম্মিলিত শাস্তি:** আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর এমন সম্মিলিত শাস্তি আরোপ করার কোনো অধিকার নেই। এটি স্পষ্টতই ফিলিস্তিনিদের সম্মিলিত শাস্তি দেওয়ার একটি কৌশল।
* **অর্থনৈতিক ক্ষতি:** কারফিউর কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকছে, কর্মজীবী মানুষ কাজ হারাচ্ছেন, যা হেবরনের এমনিতেই ভঙ্গুর অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে তুলছে।
* **মানসিক চাপ ও হতাশা:** প্রতিনিয়ত বিধিনিষেধ, অপমান এবং অনিশ্চয়তা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে গভীর মানসিক চাপ ও হতাশা তৈরি করছে।
হেবরন ফিলিস্তিনের প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি, কিন্তু একই সাথে এটি ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও বসতি স্থাপনকারীদের উপস্থিতির কারণে সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত স্থানগুলিরও একটি। শহরের কেন্দ্রস্থলে কয়েকশ কট্টরপন্থী ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী বাস করে, যাদের সুরক্ষার অজুহাতে ফিলিস্তিনিদের ওপর প্রায়শই কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ফিলিস্তিনিদের জন্য রাস্তাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, চেকপয়েন্ট বসানো হয় এবং সামরিক নজরদারি বাড়ানো হয়। ইব্রাহিমি মসজিদ বন্ধ ঘোষণা ও কারফিউ আরোপ এই দীর্ঘদিনের প্যাটার্নেরই একটি অংশ।
এই ধরনের ঘটনা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হওয়া সত্ত্বেও, বিশ্ব সম্প্রদায়ের নীরবতা প্রায়শই হতাশাজনক। যখন একটি জনগোষ্ঠীকে তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং চলাচলের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, তখন বিশ্ব বিবেককে সোচ্চার হওয়া উচিত। হেবরনে যা ঘটছে, তা কেবল স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের সমস্যা নয়, এটি বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি বড় পরীক্ষা।
হেবরনের ইব্রাহিমি মসজিদ বন্ধ ঘোষণা এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর কারফিউ আরোপের ঘটনাটি কেবল একটি নির্দিষ্ট দিনের খবর নয়, এটি ফিলিস্তিনিদের চলমান সংগ্রামের এক বেদনাদায়ক অংশ। এই ধরনের পদক্ষেপ কেবল উত্তেজনা বৃদ্ধি করে এবং শান্তির পথকে আরও রুদ্ধ করে। হেবরনে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও সহাবস্থান নিশ্চিত করা জরুরি। ফিলিস্তিনিদের আশা, বিশ্ব এই অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এবং তাদের মৌলিক অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেবে।
—



