## হুমায়ুন আহমেদের নাটক প্রচারিত হলে মানুষ দোকানপাট বন্ধ করে বাসায় ফিরত শুধু তা দেখার জন্য: চঞ্চল চৌধুরী
কিছু মন্তব্য এমন থাকে যা কেবল একটি সময়ের চিত্রই তুলে ধরে না, বরং একটি জাতির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দলিল হয়ে যায়। জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর সম্প্রতি করা একটি মন্তব্য তেমনই এক অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলেছে। তিনি বলেছেন, **”হুমায়ুন আহমেদের নাটক যখন টিভিতে প্রচারিত হতো, তখন মানুষ দোকানপাট বন্ধ করে বাসায় ফিরত শুধু তা দেখার জন্য।”**
এই একটি বাক্যই হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্টিকর্মের প্রতি বাঙালির নির্ভেজাল ভালোবাসা এবং তার প্রভাবের গভীরতা অনায়াসে বুঝিয়ে দেয়।
### হুমায়ুন আহমেদের স্বর্ণযুগ: এক অটুট বন্ধন
এটি কেবল কথার কথা ছিল না। নব্বইয়ের দশকের প্রজন্ম, এমনকি তার আগের ও পরের অনেক দর্শকই স্বীকার করবেন যে, হুমায়ুন আহমেদের নাটকগুলো বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল। তাঁর চরিত্রের মাঝে বাঙালি নিজেদের খুঁজে পেত, সংলাপগুলোতে প্রতিধ্বনিত হতো দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না। ‘কোথাও কেউ নেই’-এর বাকের ভাইয়ের ফাঁসি ঠেকাতে মানুষের মিছিল, ‘আজ রবিবার’-এর অদ্ভুত চরিত্রগুলো নিয়ে আলোচনার ঝড়, কিংবা ‘বহুব্রীহি’-এর ‘তুই রাজাকার’ সংলাপের আবেদন – এ সবই ছিল হুমায়ুন আহমেদের লেখার জাদুকরী প্রভাব।
টিভি বিনোদনের সীমিত সুযোগে, বিটিভি ছিল বিনোদনের মূল মাধ্যম। আর সেই বিটিভিতে হুমায়ুন আহমেদের নাটক মানেই ছিল এক অন্যরকম উৎসব। টিভির সামনে পরিবারের সবাই একসাথে বসা, প্রতিবেশীদের বাড়িতে টিভির শব্দ শুনতে পাওয়া – এ সবই ছিল এক সাধারণ চিত্র। মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত সাপ্তাহিক নাটকের জন্য। একবার নাটক শুরু হলে, সব কাজ ফেলে টিভির সামনে বসা ছিল এক অলিখিত নিয়ম।
### চঞ্চল চৌধুরীর চোখে: একটি প্রজন্মের সত্যভাষণ
বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম সফল ও গুণী অভিনেতা হিসেবে চঞ্চল চৌধুরীর এই মন্তব্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি হয়তো সেই সোনালী সময়ে সরাসরি অভিনয় করেননি, কিন্তু দর্শক হিসেবে, একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ হিসেবে তিনি সেই প্রভাব খুব কাছ থেকে দেখেছেন ও অনুভব করেছেন। তার মন্তব্যটি স্মরণ করিয়ে দেয়, টিভি বিনোদনের আজকের এই ডিজিটাল যুগে যেখানে অসংখ্য অপশন, সেখানে এমন একঘেয়ে বিনোদনের যুগেও একজন লেখকের ক্ষমতা কতটা শক্তিশালী হতে পারে।
চঞ্চল চৌধুরীর এই কথাগুলো কেবল স্মৃতিচারণ নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক সত্যের পুনরুল্লেখ। এমন দিন খুব কমই দেখা যায়, যখন একজন লেখকের সৃষ্টিকর্ম পুরো দেশের মানুষকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে, একটি নির্দিষ্ট কাজ থেকে বিরত রেখে নিজেদের কাছে টেনে আনতে পারে।
### হুমায়ুন আহমেদের ম্যাজিক: চরিত্র, সংলাপ আর জীবনদর্শন
হুমায়ুন আহমেদ কেবল গল্প লিখতেন না, তিনি যেন পুরো বাঙালি মধ্যবিত্তের মনস্তত্ত্বকে পর্দায় তুলে আনতেন। তার নাটকে যেমন ছিল নিখাদ হাস্যরস, তেমনই থাকত গভীর জীবনদর্শন, সম্পর্কের জটিলতা আর এক অদৃশ্য বিষাদ। তার চরিত্রগুলো এতটাই জীবন্ত ছিল যে, তারা যেন হয়ে উঠত আমাদেরই প্রতিবেশী, আমাদেরই আত্মীয়। ‘তুই রাজাকার’ হোক বা ‘শোক প্রস্তাব পাশ’ – তার সংলাপগুলো মানুষের মুখে মুখে ফিরত, যা এখনও বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে স্থান করে আছে।
ইউটিউব বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের যুগ ছিল না তখন। মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত সাপ্তাহিক নাটকের জন্য। আর একবার শুরু হলে, সব কাজ ফেলে টিভির সামনে বসা ছিল এক অলিখিত নিয়ম। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত, প্রতিটি ঘরে হুমায়ুন আহমেদের নাটক নিয়ে এক অন্যরকম আমেজ তৈরি হতো। মানুষ দোকানপাট বন্ধ করে দিত, যেন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক মিলনমেলার আয়োজন হয়েছে।
### এক চিরন্তন উত্তরাধিকার
আজও হুমায়ুন আহমেদের নাটকগুলো ইউটিউবে বা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে খুঁজে খুঁজে দেখে দর্শক। তার রচনার আবেদন আজও অমলিন। তিনি বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের একটি স্বর্ণযুগ তৈরি করেছিলেন, যার মানদণ্ড আজও অনেক নির্মাতার জন্য অনুপ্রেরণা।
চঞ্চল চৌধুরীর এই মন্তব্যটি কেবল একটি স্মৃতিকথা নয়, এটি একজন কিংবদন্তী লেখকের প্রতি এক জাতির ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। হুমায়ুন আহমেদ হয়তো শারীরিকভাবে নেই, কিন্তু তার সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে আছেন কোটি বাঙালির হৃদয়ে, অমর হয়ে আছেন তার ম্যাজিক ছড়ানো নাটকের পরতে পরতে। আর তার সেই ম্যাজিকের প্রমাণ হিসেবেই রয়ে গেছে এমনসব ঐতিহাসিক মন্তব্য, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেয় – হুমায়ুন আহমেদ ছিলেন অনন্য, অদ্বিতীয়।
—



