**ব্যাংক খাতে ‘পরিবারতন্ত্র’ নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে সরকার**
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত একটি সমস্যা হলো তথাকথিত ‘পরিবারতন্ত্র’, যা ব্যাংকিং খাতের সুশাসন ও স্বচ্ছতার জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সমস্যা মোকাবিলায় কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে এই ‘পরিবারতন্ত্রের’ লাগাম টানার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য হলো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রভাব হ্রাস করে পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা।
ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরে কিছু প্রভাবশালী শিল্পগোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো, প্রিমিয়ার গ্রুপ, সিকদার গ্রুপসহ বেশ কিছু শিল্পগোষ্ঠী এই সুযোগের অপব্যবহার করেছে। তারা কেবল নিজেদেরই নয়, বরং তাঁদের স্ত্রী/স্বামী, ছেলে-মেয়ে, জামাতা এবং নিকটাত্মীয়দের ব্যাংকের পর্ষদে বসিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে। এর ফলে ব্যাংকের সুশাসন ব্যাহত হয়েছে এবং আমানতকারীদের স্বার্থ হুমকির মুখে পড়েছে। এমন চর্চা ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয় এবং সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করে তোলে।
এই গুরুতর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর একটি খসড়া প্রস্তুত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এই সংশোধনীতে পরিবারের সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে কোনো একটি নির্দিষ্ট পরিবারের সদস্যরা পরোক্ষভাবেও ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে না পারে। পাশাপাশি, একই পরিবার থেকে পরিচালকদের সংখ্যা কমানো হবে এবং একজন পরিচালক একটানা কত সময় পদে থাকতে পারবেন, তার সময়সীমাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। এর উদ্দেশ্য হলো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে অধিকতর বৈচিত্র্য ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা এবং একক বা পারিবারিক আধিপত্য রোধ করা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করছেন, পরিবারের সংজ্ঞা বিস্তৃত করা এবং পরিচালকদের পদে থাকার সময়সীমা কমানো হলে কোনো ব্যাংককে একটি নির্দিষ্ট পরিবারের কবজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। এই সংস্কারগুলো ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি কমাতে সাহায্য করবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করবে। এটি ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য উন্নতিতে ভূমিকা রাখবে এবং আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষিত রাখতে সহায়তা করবে। এই পদক্ষেপগুলো দেশের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতা জোরদার করবে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই কঠোর অবস্থান ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। একটি সুস্থ ও শক্তিশালী ব্যাংকিং খাত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। এই সংস্কারগুলো সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ভবিষ্যতে আরও নির্ভরযোগ্য, পেশাদার ও জনমুখী হয়ে উঠবে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনবে।



