সোনা – শুধু অলংকার নয়, বিনিয়োগের অন্যতম ভরসাস্থলও বটে। তবে যারা এই মূল্যবান ধাতুতে বিনিয়োগের কথা ভাবছেন, তাদের জন্য সাম্প্রতিক খবরটি রীতিমতো বিস্ময়কর। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দেশের স্বর্ণবাজারে আবারও রচিত হলো নতুন ইতিহাস। টানা দুই দিনের ব্যবধানে ভরিতে প্রায় সাত হাজার টাকা বেড়ে এই মূল্যবান ধাতু এখন দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামে পৌঁছেছে।
মাত্র ২৪ ঘণ্টায় আবারও রেকর্ড ভাঙল স্বর্ণের দামবুধবার (৮ অক্টোবর) রাতে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) এক বিজ্ঞপ্তিতে নতুন দামের ঘোষণা দেয়, যা কার্যকর হবে বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) থেকে। বাজুসের ঘোষণা অনুযায়ী, প্রতি ভরিতে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৯০৬ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে, যা দেশের স্বর্ণের ইতিহাসে একদিনে দাম বাড়ার অন্যতম সর্বোচ্চ রেকর্ড। এর ফলে সবচেয়ে ভালো মানের ২২ ক্যারেট স্বর্ণের এক ভরির দাম দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ৯ হাজার ১০১ টাকা— যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
শুধুমাত্র ২২ ক্যারেট নয়, অন্য ক্যারেটের স্বর্ণ এবং রুপার দামও বেড়েছে। নতুন দামের তালিকা অনুযায়ী:
* **২২ ক্যারেট স্বর্ণ:** প্রতি ভরি ২ লাখ ৯ হাজার ১০১ টাকা
* **২১ ক্যারেট স্বর্ণ:** প্রতি ভরি ১ লাখ ৯৯ হাজার ৫৯৪ টাকা
* **১৮ ক্যারেট স্বর্ণ:** প্রতি ভরি ১ লাখ ৭১ হাজার ৮৮ টাকা
* **সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণ:** প্রতি ভরি ১ লাখ ৪২ হাজার ৩০১ টাকা
তবে স্বর্ণ ক্রয়ের সময় সরকার-নির্ধারিত ৫ শতাংশ ভ্যাট এবং বাজুস নির্ধারিত ন্যূনতম ৬ শতাংশ মজুরি যোগ হবে। গহনার ডিজাইন ও মান অনুযায়ী মজুরি পরিবর্তিত হতে পারে।
স্বর্ণের দামের পাশাপাশি রুপার দামেও লেগেছে রেকর্ড বৃদ্ধির ছোঁয়া। নতুন দামের হিসাবে:
* **২২ ক্যারেট রুপা:** প্রতি ভরি ৪ হাজার ৯৮১ টাকা
* **২১ ক্যারেট রুপা:** প্রতি ভরি ৪ হাজার ৭৪৭ টাকা
* **১৮ ক্যারেট রুপা:** প্রতি ভরি ৪ হাজার ৭১ টাকা
* **সনাতন পদ্ধতির রুপা:** প্রতি ভরি ৩ হাজার ৫৬ টাকা
মূলত আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির অনিশ্চয়তাই এর প্রধান কারণ। যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার কমানোর সম্ভাবনা, সরকারি কার্যক্রম আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা— এসবই বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণের দিকে ঝুঁকতে উৎসাহিত করছে। এর প্রভাবে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো স্বর্ণের দাম আউন্সপ্রতি ৪ হাজার ডলার অতিক্রম করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বাজারসংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ডলারের দামের ওঠানামাও স্বর্ণে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের বাজারেও। বাজুসের বিজ্ঞপ্তিতেও জানানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি এবং স্থানীয় পর্যায়ে তেজাবি স্বর্ণের দাম বাড়ার প্রভাবেই দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম নতুন করে সমন্বয় করা হয়েছে।
আগে মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) বাজুস স্বর্ণের দাম সমন্বয় করেছিল। সেদিন ২২ ক্যারেটের এক ভরিতে ১ হাজার ৪৬৯ টাকা বাড়িয়ে দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ২ লাখ ২ হাজার ১৯৫ টাকা। সেই দাম কার্যকর হওয়ার মাত্র একদিন পরেই বুধবারের ঘোষণায় দাম আরও ৬ হাজার ৯০৬ টাকা বাড়ানো হলো, যা একদিনে দামের সর্বোচ্চ বৃদ্ধিগুলোর মধ্যে অন্যতম।
বাজুসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এখন পর্যন্ত মোট ৬৩ বার দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৫ বার দাম বেড়েছে, আর কমেছে মাত্র ১৮ বার। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, দেশের স্বর্ণবাজার কতটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের অস্বাভাবিক উত্থান অব্যাহত থাকলে দেশের বাজারেও আগামী সপ্তাহে আরও এক দফা সমন্বয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ স্থানীয় স্বর্ণের বাজার এখন আন্তর্জাতিক দামের ওঠানামার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। টানা দুই দিনের ব্যবধানে দেশে ভরিতে ৮ হাজার টাকার বেশি দাম বেড়ে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম ২ লাখ টাকার সীমা অতিক্রম করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা, ডলারের দর পরিবর্তন এবং স্থানীয় চাহিদা বৃদ্ধির প্রভাবে এই উর্ধ্বগতি সাময়িক নয় বলেই মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। এমতাবস্থায়, স্বর্ণে বিনিয়োগ বা অলংকার ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবদিক ভালোভাবে পর্যালোচনা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ভবিষ্যতে স্বর্ণের বাজারে কী অপেক্ষা করছে, তা দেখতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।



