**বিশ্ববাজারে গমের দাম কমলেও দেশের বাজারে বাড়লো আটার দাম: এক অদৃশ্য টানাপোড়েন**
খবরটা নিশ্চয়ই অনেকের চোখ কপালে তুলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন গমের দাম কমছে, তখন আমাদের দেশের বাজারে আটার দাম উল্টো বাড়ছে! এ কেমন বৈপরীত্য? একদিকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার কথা, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির জন্য বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। কেন এমন হচ্ছে? এই অদৃশ্য টানাপোড়েনের পেছনে আসলে কোন কারণগুলো দায়ী? চলুন, আজ আমরা এই বিষয়টি বিস্তারিতভাবে জেনে নিই।
**বিশ্ববাজারে গমের দাম কমার কারণ কী?**
প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক, বিশ্ববাজারে গমের দাম কেন কমছে। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে:
1. **ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল:** রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের অন্যতম প্রধান গম উৎপাদনকারী দেশ। যুদ্ধের কারণে সরবরাহে যে বিঘ্ন ঘটেছিল, তা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। কৃষ্ণ সাগর দিয়ে গম রপ্তানির পথ খুলে যাওয়ায় বাজারে সরবরাহ বেড়েছে।
2. **রেকর্ড ফলন:** বিশ্বের অনেক গম উৎপাদনকারী দেশে এবার রেকর্ড পরিমাণ ফলন হয়েছে। ফলে বাজারে গমের সরবরাহ চাহিদার তুলনায় বেশি।
3. **বিভিন্ন দেশের মজুত বৃদ্ধি:** অনেক দেশ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গমের মজুত বাড়িয়েছে, যা ভবিষ্যতে সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করছে।
4. **বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা:** অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কায় অনেক পণ্যের দামের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে, যার প্রভাব গমের বাজারেও দেখা গেছে।
**তাহলে দেশের বাজারে আটার দাম বাড়ছে কেন?**
বিশ্ববাজারে দাম কমার পরও আমাদের দেশে আটার দাম বাড়ার পেছনে রয়েছে একাধিক জটিল কারণ। এর কয়েকটি নিচে দেওয়া হলো:
1. **ডলারের বিনিময় হার:** এটি সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণ। বিশ্ববাজারে গমের দাম ডলারের হিসাবে কমলেও, দেশের বাজারে আমদানি করতে গিয়ে ডলারের উচ্চ বিনিময় মূল্য चुकाতে হচ্ছে। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায়, কম দামে কেনা গমও দেশের মুদ্রায় বেশি দামে পড়ছে।
2. **পরিবহন ব্যয় ও জ্বালানি তেলের দাম:** আন্তর্জাতিক বাজারে জাহাজ ভাড়া ও দেশের অভ্যন্তরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহন ব্যয় অনেক বেড়েছে। গম বন্দরে আসার পর তা মিল পর্যন্ত এবং সেখান থেকে আটা ডিলার ও দোকানে পৌঁছানো পর্যন্ত সব ধাপে এই বাড়তি পরিবহন খরচ যুক্ত হচ্ছে।
3. **শুল্ক ও অন্যান্য কর:** গম আমদানির ক্ষেত্রে আরোপিত শুল্ক ও অন্যান্য কর দেশের বাজারে এর দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। সরকারের যদি শুল্ক কাঠামো পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ থাকে, তাহলে হয়তো দামে কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে।
4. **মজুত ও সরবরাহ চেইনের খরচ:** আমদানিকৃত গম দীর্ঘ সময় মজুত করতে গেলে গুদাম ভাড়া, রক্ষণাবেক্ষণ ও আনুষঙ্গিক খরচ যোগ হয়। এছাড়া, সরবরাহ চেইনের প্রতিটি ধাপে (আমদানিকারক, মিলার, পাইকারি বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা) যুক্তিসঙ্গত মুনাফার পাশাপাশি অন্যায্য মুনাফার প্রবণতাও দেখা যায়।
5. **মিল মালিকদের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি:** বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বাড়ার কারণে মিল মালিকদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এই খরচ তারা আটার দামে সমন্বয় করে থাকেন।
6. **বাজার মনিটরিংয়ের অভাব:** বাজারে পর্যাপ্ত মনিটরিং না থাকার কারণে অনেক সময় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে দেয়। সিন্ডিকেট করে দাম নিয়ন্ত্রণের অভিযোগও প্রায়ই শোনা যায়।
**ভোক্তাদের ওপর প্রভাব:**
আটার দাম বাড়ার সরাসরি প্রভাব পড়ছে সাধারণ ভোক্তাদের ওপর। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আটা দৈনন্দিন খাবারের একটি অপরিহার্য অংশ। রুটি, পরোটা, বিস্কুটসহ নানা রকম খাদ্যপণ্যের মূল উপাদান এটি। এর দাম বাড়লে সরাসরি জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে। এতে করে মানুষের দৈনন্দিন বাজেট ভেঙে যায় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে ঘাটতি দেখা দেয়।
**কী করণীয়?**
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সমন্বিত পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি:
* **বাজার মনিটরিং জোরদার করা:** বাজারে কার্যকর ও নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
* **ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখা:** কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
* **শুল্ক কাঠামো পুনর্বিবেচনা:** আমদানি শুল্ক ও অন্যান্য করের বিষয়টি সাময়িকভাবে পুনর্বিবেচনা করে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ কমানো যেতে পারে।
* **সরবরাহ চেইন সহজ ও সাশ্রয়ী করা:** পরিবহন ও অন্যান্য লজিস্টিক খরচ কমাতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
* **মজুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ:** সরকারের নিজস্ব মজুত পরিস্থিতি শক্তিশালী করা এবং বেসরকারি মজুতদারদের ওপর নজরদারি বাড়ানো।
* **স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি:** দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য দেশের অভ্যন্তরে গমের উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের উৎসাহিত করা এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা।
**শেষ কথা:**
বিশ্ববাজারে গমের দাম কমার পরও দেশের বাজারে আটার দাম বেড়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে হতাশাজনক। এটি কেবল অর্থনীতির জটিলতারই প্রমাণ নয়, বরং বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বেরও প্রতিচ্ছবি। এই পরিস্থিতিতে সরকারের দ্রুত ও কার্যকর হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি, যাতে সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটি সাশ্রয়ী মূল্যে পেতে পারে এবং দেশের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে।



