বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম কালো অধ্যায়, পিলখানা বিডিআর হত্যাকাণ্ড। প্রায় দেড় দশক ধরে এই ভয়াবহ ঘটনার পেছনের সত্য উন্মোচনের অপেক্ষায় ছিল জাতি। সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সম্প্রতি গঠিত কমিশন তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত তদন্ত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছে। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য, যা গোটা জাতিকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে।
**প্রতিবেদন জমা ও মূল সমন্বয়কের পরিচয়**
গত রোববার (৩০ নভেম্বর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেন কমিশন প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান এবং অন্যান্য সদস্যরা। কমিশনের অন্যান্য সদস্যরা হলেন মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার (অব.), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাইদুর রহমান বীর প্রতীক (অব.), মুন্সী আলাউদ্দিন আল আজাদ যুগ্মসচিব (অব.), ড. এম. আকবর আলী ডিআইজি (অব.), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. শরীফুল ইসলাম এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন।
এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মূল সমন্বয়ক ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস। তার সরাসরি নেতৃত্বে এই ভয়াবহ ঘটনা সংঘটিত হয় বলে কমিশন জানিয়েছে।
**আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ‘গ্রিন সিগন্যাল’**
কমিশনের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে আরও গুরুতর অভিযোগ। তদন্তে বিডিআর হত্যাকাণ্ডে বহিঃশক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততা এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সরাসরি জড়িত থাকার শক্তিশালী প্রমাণ মিলেছে। কমিশনের সদস্য জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার বলেন, এই হত্যাকাণ্ড ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং এর পেছনে তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন।
তিনি আরও জানান, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের রক্ষা করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সরাসরি ভূমিকা রেখেছে। তারা ২০-২৫ জনের একটি মিছিল নিয়ে পিলখানায় ঢুকেছিল এবং বের হওয়ার সময় সেই মিছিলে প্রায় দুই শতাধিক মানুষ ছিল, যা প্রমাণ করে তাদের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো, পুরো ঘটনাটি সংঘটিত করার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ছিল।
**দায় নিরূপণ ও ব্যর্থতার চিত্র**
কমিশন তাদের ফাইন্ডিংস-এ এই ঘটনার দায় তৎকালীন সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সেনাপ্রধানেরও বলে উল্লেখ করেছে। এছাড়া পুলিশ, র্যাব এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চরম ব্যর্থতার দিকটিও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এই ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলেও জানানো হয়।
**তদন্ত প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জ ও প্রধান উপদেষ্টার প্রতিক্রিয়া**
কমিশন প্রধান ফজলুর রহমান জানান, তদন্তকাজ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও ত্রুটিমুক্ত করার স্বার্থে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রাখা হয়েছে। তবে তারা যখন কাজ শুরু করেন, ততদিনে ১৬ বছর আগের এই ঘটনার বহু আলামত ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকে বিদেশে চলে গেছেন। তারা দুটো প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে গেছেন – সাক্ষীদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া (কারো কারো ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত), এবং পূর্ববর্তী তদন্তে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে তাদের রিপোর্ট ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করা। এই তদন্তের মাধ্যমে বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে জনমনে থাকা প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে এবং কার কী ভূমিকা ছিল, কেন সেনাবাহিনী অ্যাকশন নেয়নি, এসব প্রশ্নের উত্তর উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রতিবেদন জমা নেওয়ার সময় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতি দীর্ঘদিন ধরে অন্ধকারে ছিল। আপনারা সত্য উদ্ঘাটনে যে ভূমিকা রেখেছেন জাতি তা স্মরণে রাখবে। জাতির পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।” তিনি আরও বলেন, ইতিহাসের এই ভয়াবহতম ঘটনা নিয়ে জাতির অনেক প্রশ্ন ছিল, এই কাজের মধ্যদিয়ে সেসব প্রশ্নের অবসান ঘটবে।
**গণমাধ্যম ও তথ্য সংরক্ষণে ব্যর্থতা**
কমিশন তাদের প্রতিবেদনে কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং কয়েকজন সাংবাদিকের অপেশাদার ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেছে। এছাড়াও, ওই হত্যাকাণ্ডের সময় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন) যেসব বিডিআর সদস্যদের সঙ্গে শেখ হাসিনা বৈঠক করেছিলেন, তাদের সঠিক নাম পরিচয় ও তথ্য সংরক্ষণ করা হয়নি বলেও জানানো হয়।
**সুপারিশ ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা**
কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে, যাতে করে ভবিষ্যতে বাহিনীগুলোতে এই ধরনের ঘটনা এড়ানো যায় এবং এই ঘটনার ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পায়।
এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক ইতিহাসের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। জাতি এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয় এবং পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পেছনে থাকা প্রকৃত সত্য সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত হয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় কিনা।



