ক্ষমতা কি মানুষকে দানবে পরিণত করে? না কি ব্যবস্থার ত্রুটিই এই দানবীয়তার জন্ম দেয়? এমন এক মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই নির্বাচনব্যাবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার দিয়েছেন এক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব – উচ্চকক্ষ গঠন। তাঁর মতে, ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ এবং কাউকে ‘দানবে’ পরিণত হওয়া থেকে ঠেকাতেই এই ‘প্রতিষেধক’ জরুরি। সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ কি জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারবে?’ শীর্ষক সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন।
বদিউল আলম মজুমদার ব্যক্তিগতভাবে উচ্চকক্ষের ধারণার সাথে শুরুতে একমত না থাকলেও, বাস্তবতার নিরিখে তিনি এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নিশ্চিত করা এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে। এই বিশ্বাস থেকেই তাঁর এই সুপারিশ, যা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সহায়ক হতে পারে।
জবাবদিহিতা না থাকার কারণেই যে ক্ষমতা দানবীয় রূপ নিতে পারে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হিসেবে বদিউল আলম মজুমদার সরাসরি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেনে এনেছেন। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক হিসেবে তিনি আরও খোলাসা করে বলেন, “শেখ হাসিনা কিন্তু ট্যাংকে করে আসেন নাই, উর্দি পরেও আসেন নাই। এসে (ক্ষমতায়) সংবিধানও বাতিল করে দেননি। তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে এসেছিলেন, যদিও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে।”
তাহলে কীভাবে শেখ হাসিনা স্বৈরাচার, দানবে পরিণত হয়েছিলেন? মজুমদার স্পষ্ট করে বলেছেন, “স্বৈরাচারী ব্যবস্থাই তাকে দানবে পরিণত করেছে।” অর্থাৎ, এখানে কোনো ব্যক্তির চেয়েও ব্যবস্থার ত্রুটি, জবাবদিহিতার অভাব এবং ক্ষমতার অসম বণ্টনই দায়ী। তাঁর মতে, “আমাদের লক্ষ্য হলো, এই ব্যবস্থার অবসান ঘটানোর জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। অবসান না ঘটলেও কিছু চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের বিষয় আসবে।”
বদিউল আলম মজুমদার এই দানবীয়তার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অসামাঞ্জস্যতাকে উল্লেখ করেছেন। তিনি ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরিসংখ্যান তুলে ধরে এর ভয়াবহতা স্পষ্ট করেন:২০০১ সালের নির্বাচন:** বিএনপি ৪০.৯৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪০.১৩ শতাংশ ভোট। ভোটের ব্যবধান ছিল সামান্য। কিন্তু আসনের ক্ষেত্রে বিএনপি পায় ১৯৩টি আসন, যেখানে আওয়ামী লীগ পায় মাত্র ৬২টি আসন।
২০০৮ সালের নির্বাচন নৌকায় ভোট পড়ে ৪৮.৪ শতাংশ, ফলে তারা পায় ২৩০টি আসন। অন্যদিকে, ধানের শীষে ভোট পড়ে ৩২.৫০ শতাংশ, কিন্তু তারা মাত্র ৩০টি আসন পায়।
এই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ভোটের সামান্য ব্যবধানও কীভাবে বিপুল আসনের পার্থক্যে রূপ নিতে পারে। এই অসামাঞ্জস্যতা একটি বড় দুর্বলতা, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা দেয় এবং তাদের জবাবদিহিতা বিহীন করে তোলে। বদিউল আলম মজুমদার আরও মনে করিয়ে দেন যে, ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপির কার্যক্রমও এক-এগারোর মতো পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিল। এসব পরিস্থিতি ঠেকাতেই উচ্চকক্ষের প্রস্তাব, যা একটি কার্যকর চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স তৈরি করবে এবং একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ক্ষমতাকে লাগাম পরাবে।
দিউল আলম মজুমদারের উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব কেবল একটি নতুন সংসদীয় কাঠামো তৈরি নয়, বরং এটি ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সুরক্ষিত রাখার একটি প্রচেষ্টা। যখন ব্যবস্থার ত্রুটি মানুষকে দানবে পরিণত করার সুযোগ তৈরি করে, তখন সেই ব্যবস্থা সংস্কারই হয় একমাত্র উপায়।
আশা করা যায়, এই প্রস্তাবনা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার দুর্বলতা দূর করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি আরও স্থিতিশীল ও জবাবদিহিতামূলক শাসন উপহার দিতে সহায়ক হবে, যেখানে কোনো ব্যক্তি বা দলই ‘দানব’ হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে না। এই উচ্চকক্ষ কি সত্যিই আমাদের গণতন্ত্রের জন্য একটি কার্যকর প্রতিষেধক হয়ে উঠতে পারবে? প্রশ্নটি আলোচনার কেন্দ্রে, এবং এর সমাধান খুঁজে বের করা সময়ের দাবি।



