জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরের চাপ। বিশেষ করে বিএনপি, তাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর থেকে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও অসন্তোষের এক নতুন ঢেউয়ের মুখোমুখি। দলের ভেতরের এই অস্থিরতা এখন এতটাই প্রকট যে, কমপক্ষে ৪০টি আসনে মনোনয়ন নিয়ে তৈরি হয়েছে তীব্র অসন্তোষ, যা দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে ফেলেছে গভীর চিন্তায়। দলের ঐক্য ও ভোটব্যাংক সুরক্ষিত রাখতে এই আসনগুলো পুনর্বিবেচনার পথে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে বিএনপি।
**ক্ষোভ, বিক্ষোভ ও বিভাজন: এক অস্বস্তিকর চিত্র**
মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই বিএনপির ভেতরে ক্ষোভ, বিক্ষোভ ও বিভাজন থামছে না। দেশের কমপক্ষে ৪০টি আসনে মনোনয়ন নিয়ে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, যার প্রকাশ দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন উপায়ে। কোথাও মিছিল, কোথাও সড়ক অবরোধ, আবার কোথাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ্য বিরোধিতা – সব মিলিয়ে দলের ভেতর অস্বস্তি স্পষ্ট। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, মনোনয়নবঞ্চিতদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার আশঙ্কায় রীতিমতো চাপে পড়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এমনটা ঘটলে দলের ভোটব্যাংক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
**কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তৎপরতা: আলোচনার টেবিলে সমাধান**
এই সংকট মোকাবিলায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব দ্রুত তৎপর হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলরা বিরোধপূর্ণ আসনের সব পক্ষকে ঢাকায় ডেকে একে একে কথা বলছেন। তাদের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে যেন কেউ দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, এমন কোনো পদক্ষেপ না নেন। এরই মধ্যে জয়পুরহাট, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, ময়মনসিংহসহ কয়েকটি জেলার বঞ্চিত নেতাদের সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে। এসব বৈঠকে পরিস্থিতি শান্ত করার এবং দলের বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। আশার কথা হলো, কিছু আসনে প্রার্থী পুনর্বিবেচনার সম্ভাবনার ইঙ্গিতও মিলেছে।
**বিশেষ কিছু আসনে তীব্র বিরোধের চিত্র**
দলের ভেতরের এই অস্থিরতার কিছু উদাহরণ পরিস্থিতিকে আরও স্পষ্ট করে তোলে:
* **নাটোর-১:** এই আসনের বিরোধ যেন পুরো বিষয়টির প্রতীক হয়ে উঠেছে। সেখানে ফারজানা শারমিন মনোনয়ন পাওয়ার পর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম ও ফারজানার ভাই ইয়াছির আরশাদ। গুলশানে ডেকে তাঁদের বোঝান মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। নির্দেশনা দেওয়া হয় পরিস্থিতি আর না ঘোলাটে করতে।
* **ফেনী-২:** এই আসনের ‘শৈল্পিক’ বিক্ষোভ এবার আলোচনায় উঠে এসেছে সবচেয়ে বেশি। ধানখেতে দাঁড়িয়ে ক্রিকেটারের ভঙ্গিতে রিভিউ চাওয়ার একটি ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, যা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। জেলা বিএনপির নেতা আলাল উদ্দিনসহ সাতজন মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার জন্য লিখিত আবেদনও করেছেন। তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত পায়নি তারা।
* **মাদারীপুর-১:** এখানে সবচেয়ে জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কামাল জামান মোল্লার নাম ঘোষণার পরই তার বিরোধিতা করে সড়ক অবরোধ করেন আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী লাভলু সিদ্দিকীর সমর্থকেরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এরপর প্রার্থী ঘোষণা স্থগিত করে দল। দুই পক্ষের গ্রহণযোগ্যতা, অতীত ভূমিকা, স্থানীয় প্রভাব – সব বিবেচনায় ফেলেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে শীর্ষ নেতৃত্বকে।
শুধু এই কয়েকটি আসনই নয়, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইল, জামালপুর, দিনাজপুর, পাবনা, নওগাঁসহ সারাদেশে একই চিত্র। কোথাও কাফনের কাপড় পরে মিছিল, কোথাও মহাসড়ক অবরোধ, কোথাও ফাঁসির মঞ্চের প্রতীকী প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে। পরিস্থিতি কতটা গুরুতর, তা বোঝাতে একাধিক এলাকায় বিক্ষুব্ধদের বোঝাতে ব্যক্তি উদ্যোগে কথা বলছেন তারেক রহমানও।
**কেন এবারের অসন্তোষ এত বেশি?**
দলের দায়িত্বশীল নেতাদের ভাষ্য, সাধারণত বড় দলে মনোনয়ন নিয়ে কিছু অসন্তোষ থাকেই। কিন্তু এবার তা বেড়েছে কয়েকটি কারণে। মাঠের নেতাদের দাবি, অযোগ্যদের বাদ দিয়ে গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে প্রার্থী ঠিক না করলে বিজয় কঠিন হয়ে যাবে। তাই প্রয়োজনে নিরপেক্ষ জরিপের অনুরোধও জানাচ্ছেন তারা। আবার অনেকেই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে দলের ক্ষতি হয়, এমন কিছু তারা করবেন না।
**মহাসচিবের ইঙ্গিত ও দলের চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ**
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজেও বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, “অনেক জায়গাতেই দু-তিনজন করে নেতা মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্য ছিলেন। ঘোষণার পর স্বাভাবিকভাবেই ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। আলাপ–আলোচনা করে তা সমাধানের চেষ্টা চলছে।” তিনি কতগুলো আসনে পুনর্বিবেচনা হতে পারে – সেই ইঙ্গিতও দিয়েছেন।
দলীয় পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, অসন্তোষ দমাতে ব্যর্থ হলে কিছু আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড়াতে পারেন। তাতে দলের ভোটব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এ কারণেই শেষ পর্যন্ত দলকে বাঁচাতে এবং মাঠের ঐক্য রক্ষায় বিএনপি প্রার্থী তালিকায় পুনর্বিবেচনার পথে হাঁটছে। এটি একটি রাজনৈতিক দলের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত, যা তাদের নির্বাচনী ভবিষ্যতের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে।
বিএনপির জন্য এটি এক কঠিন পরীক্ষা। ভবিষ্যৎ রাজনীতির দিক থেকে এই সংকট মোকাবিলা করা তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৪০টি আসনে পুনর্বিবেচনার এই উদ্যোগ একদিকে যেমন দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ইঙ্গিত দেয়, তেমনি অন্যদিকে একটি ঐক্যবদ্ধ দল হিসেবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্পও প্রকাশ করে। এখন দেখার বিষয়, শীর্ষ নেতৃত্ব কতটা দক্ষতার সাথে এই চ্যালেঞ্জ সামলে ওঠে এবং একটি শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ বিএনপি নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নামতে পারে।
—



