## গাজায় প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক বাহিনী ‘ISF’: কী এর উদ্দেশ্য, কারা থাকতে পারে এতে?
গাজা উপত্যকার বর্তমান পরিস্থিতি ভয়াবহ। মাসের পর মাস ধরে চলা সংঘাত, ধ্বংসযজ্ঞ এবং মানবিক সংকট বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে নানা প্রস্তাবনা উঠে আসছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো একটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী (International Stabilization Force – ISF) গঠনের ধারণা। কিন্তু এই বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য কী, এবং কারা এর সদস্য হতে পারে? চলুন, বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
### গাজার জন্য কেন একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী?
গাজা উপত্যকা বর্তমানে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। হামাসের সামরিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (PA) পক্ষে এখনই গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া কঠিন। ইসরায়েলও গাজার বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহী। এই ক্ষমতাশূন্যতা এবং অস্থিতিশীলতা নতুন করে সংঘাত ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে:
* **স্থিতিশীলতা আনা:** সংঘাত পরবর্তী সময়ে গাজায় আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং নতুন করে সহিংসতা রোধ করা।
* **মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা:** নিরাপদে এবং নির্বিঘ্নে মানবিক সহায়তা গাজার মানুষের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করা।
* **পুনর্গঠনের পথ তৈরি করা:** ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর গাজার অবকাঠামো পুনর্গঠনের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা।
* **অন্তর্বর্তীকালীন শাসন:** একটি স্থিতিশীল ফিলিস্তিনি প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত গাজার নিরাপত্তা ও সিভিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করা।
### এর উদ্দেশ্য ও ম্যান্ডেট কী হতে পারে?
একটি আন্তর্জাতিক বাহিনীর প্রধান উদ্দেশ্যগুলো সাধারণত একটি সুনির্দিষ্ট ম্যান্ডেটের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। গাজার ক্ষেত্রে এই ISF-এর সম্ভাব্য উদ্দেশ্য ও ম্যান্ডেট নিম্নরূপ হতে পারে:
1. **নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা:** গাজায় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সংঘাতপূর্ণ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ প্রতিরোধ করা এবং আইন প্রয়োগে সহায়তা করা।
2. **সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ:** ইসরায়েল ও মিশরের সঙ্গে গাজার সীমান্ত এবং সমুদ্রপথে অস্ত্র পাচার রোধ করা।
3. **মানবিক সহায়তা সরবরাহ:** আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর জন্য একটি নিরাপদ করিডোর তৈরি করা এবং ত্রাণ বিতরণে সহায়তা করা।
4. **যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ:** যেকোনো স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকরভাবে পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োগ করা।
5. **পুনর্গঠন কাজে সহায়তা:** ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকাগুলোতে পুনর্গঠন কার্যক্রম চলাকালীন নিরাপত্তা প্রদান করা।
6. **অন্তর্বর্তীকালীন সিভিল শাসন:** ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বা একটি নতুন ফিলিস্তিনি সরকার যতক্ষণ না পর্যন্ত গাজার পূর্ণ প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নিতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কিছু সিভিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করা।
### কারা থাকতে পারে এই বাহিনীতে?
প্রস্তাবিত এই আন্তর্জাতিক বাহিনীর সম্ভাব্য সদস্যদের নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। এর গঠনে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উভয় পক্ষের অংশগ্রহণ জরুরি বলে মনে করা হয়।
1. **আরব দেশগুলো:** মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ এই বাহিনীতে সৈন্য পাঠাতে আগ্রহ দেখাতে পারে। বিশেষ করে, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং কাতার-এর মতো দেশগুলো আঞ্চলিক গ্রহণযোগ্যতা এবং আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাদের অংশগ্রহণ এই বাহিনীর প্রতি ফিলিস্তিনিদের আস্থা অর্জনে সহায়ক হবে।
2. **জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী:** জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে কাজ করার অভিজ্ঞতা রাখে। তবে, ইসরায়েলের ভেটো ক্ষমতা এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের জটিলতা জাতিসংঘের সরাসরি অংশগ্রহণে বাধা হতে পারে। সেক্ষেত্রে, জাতিসংঘ একটি বৃহত্তর জোটের অধীনে প্রযুক্তিগত সহায়তা বা সমর্থন দিতে পারে।
3. **মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ:** ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্কের মতো দেশগুলো, যাদের ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতি রয়েছে, তারাও এই বাহিনীতে অবদান রাখতে পারে। তাদের অংশগ্রহণ বাহিনীর বহুমাত্রিক চরিত্র তুলে ধরবে।
4. **ইউরোপীয় দেশগুলো:** ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানির মতো ইউরোপীয় দেশগুলো শান্তিরক্ষা মিশনে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তারা আর্থিক, লজিস্টিক এবং সামরিক সহায়তা দিতে পারে।
5. **মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র:** সরাসরি সেনা মোতায়েন না করলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বাহিনীর রাজনৈতিক সমর্থন, আর্থিক সহায়তা এবং লজিস্টিক সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
তবে, যে কোনো আন্তর্জাতিক বাহিনীর সফলতার জন্য ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি উভয় পক্ষের সম্মতি অত্যন্ত জরুরি। ইসরায়েলকে তার নিরাপত্তা উদ্বেগ থেকে মুক্ত থাকতে হবে, এবং ফিলিস্তিনিদের কাছে এই বাহিনী একটি দখলদার শক্তি হিসেবে বিবেচিত হওয়া যাবে না।
### চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাব্য বাধা
এই ধরনের একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠন সহজ কাজ নয়। এর পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ও বাধা রয়েছে:
* **সম্মতি:** ইসরায়েল, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং গাজার বর্তমান ডি ফ্যাক্টো শাসক হামাস-এর সম্মতি অর্জন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
* **ম্যান্ডেটের স্পষ্টতা:** বাহিনীর উদ্দেশ্য, ক্ষমতা এবং কর্মপরিধি নিয়ে সুস্পষ্ট চুক্তি থাকা আবশ্যক।
* **অর্থায়ন:** এই বিশাল বাহিনীর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কে অর্থায়ন করবে, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
* **বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা:** বাহিনীটি গাজার মানুষের কাছে কতটা বৈধ ও গ্রহণযোগ্য হবে, তা এর সফলতার জন্য জরুরি।
* **নিরাপত্তা ঝুঁকি:** গাজা অত্যন্ত সংঘাতপূর্ণ এলাকা, এখানে কাজ করার জন্য সেনাদের উচ্চ নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকবে।
* **প্রস্থান কৌশল:** বাহিনীটি কতদিন গাজায় অবস্থান করবে এবং তাদের প্রস্থানের কৌশল কী হবে, তা নির্ধারণ করা।
### উপসংহার
গাজায় একটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী গঠনের প্রস্তাবনা একদিকে যেমন আশার আলো দেখাচ্ছে, অন্যদিকে এর বাস্তবায়নে রয়েছে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ। সংঘাত-পরবর্তী গাজায় শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং পুনর্গঠনের জন্য এটি একটি সম্ভাব্য পথ হতে পারে, তবে এর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর পরিকল্পনা এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের আস্থা অর্জন অপরিহার্য। এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা ও কূটনীতি আরও জোরদার হওয়া জরুরি, যাতে গাজার মানুষ একটি শান্তিপূর্ণ ও সুরক্ষিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারে।
—



