“প্রতিশ্রুতি” শব্দটা আজকাল যেন একটা রসিকতার বস্তুতে পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে। “আমরা এটা করব!” বলাটা সহজ, কিন্তু “কবে করব?” – সেই প্রশ্নটা হলেই শুরু হয় যত ঝামেলা। আর গাজার রাফাহ ক্রসিংয়ের গল্পটা ঠিক এমনই এক প্রতিশ্রুতি আর টালবাহানার নাটক। এমন একটা নাটক, যেখানে দর্শক হিসেবে আমরা কেবল পপকর্ন হাতে (যদি গাজায় পাওয়া যায় আর কী!) বোকা বনে দেখছি।
যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী গাজায় ত্রাণ ঢোকার কথা ছিল, রাফাহ ক্রসিংও খুলে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইসরায়েল মহোদয় বলছেন, “আরে বাবা! এত তাড়াহুড়ো কিসের? হামাস সাহেবরা আগে মৃত জিম্মিদের দেহাবশেষগুলো ফেরত দিক, তারপর না হয় দেখা যাবে!” মানে, বোঝেন ঠ্যালা! ত্রাণ ঢুকবে, জীবন বাঁচবে – এসবের চেয়েও মৃতদেহগুলো ফেরত আনাটা নাকি বেশি জরুরি। যেন মৃতদেহগুলো গেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে আর মানুষের পেটে খাবার চলে আসবে! এ যেন, আপনার ঘরে আগুন লেগেছে, আর ফায়ার সার্ভিস এসে বলছে, “আগে আপনার বাড়ির রংটা ঠিক করে নিন, তারপর আমরা জল দেব।”
ঘটনার প্রেক্ষাপটও বেশ মজার। গত ১৪ই অক্টোবর, ২০২৫-এ (ভবিষ্যতের তারিখ হলেও ঘটনাটা বেশ পুরোনো ধাঁচের!) যখন যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলো, তখন গাজায় ত্রাণ ঢোকা সীমিত করলো ইসরায়েল। সে এক চুক্তি বটে! চুক্তির শর্ত ছিল, গাজায় ত্রাণবাহী ট্রাক ঢোকার কথা, রাফাহ ক্রসিংও খুলবে। শুরুতেই ইসরায়েল বেশ দিলদরিয়া হয়ে বলল, “ঠিক আছে, দিনে ৬০০টা ট্রাক ঢুকতে দেব!” তারপর কী মনে হলো কে জানে, হঠাৎ করে সংখ্যাটা কমিয়ে ৩০০ করে দিল। হয়তো ভাবল, “ইসস! এত খাবার দিলে তো ওরা শক্তিশালী হয়ে যাবে!” এ যেন বন্ধুর বিয়েতে নিমন্ত্রণ করে, শেষ মুহূর্তে খাবারের মেনু থেকে বিরিয়ানি বাদ দিয়ে শুধুই রুটি-সবজি ধরিয়ে দেওয়া।
হামাসও চুপ করে বসে থাকার পাত্র নয়। তারা বলছে, “আরে বাবা! অবিরাম বোমাবর্ষণে আমাদের রক্ষীরাই তো মারা পড়ছে, আর চারিদিকে এত ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে মৃত জিম্মিদের দেহাবশেষ খুঁজে বের করা কি বাপেরও সাধ্যের কাজ? বোমার গুঁতোয় যদি লাশগুলো ছিঁড়ে টেনিস বল হয়ে যায়, তাহলে সেগুলো খুঁজব কোথায়?” তাদের অভিযোগ, ইসরায়েলের এই “টালবাহানা” যুদ্ধবিরতি চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন। মানে, একদিকে মারছেন, অন্যদিকে খুঁজতেও বলছেন – এ তো যেমন নাচাবেন, তেমন নাচব না!
কিন্তু ইসরায়েল কি সহজে হার মানার দল? সম্প্রতি তাদের পক্ষ থেকে এক নতুন ঘোষণা এসেছে। রাফাহ ক্রসিং নাকি খুলবে! ওয়াও! দারুণ খবর, তাই না? কিন্তু টুইস্ট আছে। “তবে এটি মানবিক সহায়তার জন্য নয়, কেবল মানুষের যাতায়াতের জন্য খোলা হবে।” মানে, আপনি হেঁটে যেতে পারবেন, কিন্তু সঙ্গে এক দানা চালও নিতে পারবেন না। এ যেন হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার আপনাকে বললেন, “আপনি এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে পারবেন, তবে কোনো ওষুধপত্র নিতে পারবেন না।” আর ত্রাণ? সেটা নাকি কেরেম শালোম ক্রসিং-সহ অন্যান্য ক্রসিং দিয়ে ঢুকবে। কেন রাফাহ দিয়ে ঢুকবে না? বোধহয় রাফাহর মাটি ত্রাণবাহী ট্রাকের ভার সইতে পারে না, শুধু মানুষের পায়ের ভার সয়! কী এক এলাহি কাণ্ড!
আন্তর্জাতিক মহলও এই নাটকের দর্শক। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে নানা সংস্থা হাঁক-ডাক করছে, “গাজায় মানবিক সংকট বাড়ছে! দ্রুত সব ক্রসিং খুলে দাও!” কিন্তু কে শোনে কার কথা? কারণ, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মানবিকতার চেয়েও “আমি ঠিক, তুমি ভুল” খেলাটা বেশি উপভোগ্য। মানুষ মরছে তো মরুক, নিজেদের কাদা ছোড়াছুড়িটা আগে শেষ হোক।
এই হলো গাজার রাফাহ ক্রসিংয়ের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি। এক পক্ষ বলছে লাশ দাও, অন্য পক্ষ বলছে লাশ খুঁজে পাচ্ছি না, আর এর মাঝখানে হাজার হাজার মানুষ অভুক্ত। প্রতিশ্রুতি, চুক্তি, আন্তর্জাতিক চাপ – সব যেন তামাশার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই নাটক কবে শেষ হবে, আর কবে গাজার মানুষ পেট ভরে খেতে পাবে, তা কেবল বিধাতাই জানেন। ততদিন পর্যন্ত, আমরা শুধু আশা করতে পারি যে, অন্তত এই টালবাহানার নাটকটা দ্রুত শেষ হোক এবং মানবিকতা তার পথ খুঁজে নিক। নয়তো “প্রতিশ্রুতি” শব্দটা ডিকশনারি থেকে মুছে ফেলে দেওয়া উচিত।


