## খুলনায় মাদকের বাজার দখলেই খুন অর্ধশত: আতঙ্ক, অস্থিরতা আর সহিংসতার নতুন নাম খুলনা
এক সময় শান্ত ও ঐতিহ্যবাহী খুলনা নগরী এখন পরিণত হয়েছে আতঙ্ক, অস্থিরতা আর সহিংসতার এক ভয়ংকর জনপদে। যে শহরের বুক চিরে বয়ে যেত রূপসা নদী, আর বাতাসে বইত শান্তির সুবাতাস, সেই খুলনা এখন ভুগছে এক অদৃশ্য অথচ মারণঘাতী ব্যাধিতে – মাদকের আগ্রাসন এবং এর বাজার দখলের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে। প্রতিদিনই গুলি বা কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় এখানকার নগরবাসী ভীতসন্ত্রস্ত, আর আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি যেন ভেঙে পড়ার উপক্রম।
**মৃত্যুর মিছিল মাদকের সাম্রাজ্য দখলে**
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে, খুলনায় ছয়টি সন্ত্রাসী গ্রুপ—
বি কোম্পানি (গ্রেনেড বাবু), হুমা বাহিনী, আশিক বাহিনী, পলাশ বাহিনী, নুর আজিম বাহিনী ও আরমান বাহিনী
মাসে কমপক্ষে ৭০–১০০ কোটি টাকার মাদক বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গ্রুপগুলোর সংঘর্ষেই গত দেড় বছরে অর্ধশত মানুষ খুন হয়েছে।
**অর্থের লোভ ও অস্ত্রের ঝনঝনানি**
এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মূলে রয়েছে এক বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য – প্রতি মাসে ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকার মাদকের রমরমা বাণিজ্য। এই বিশাল অঙ্কের টাকার নিয়ন্ত্রণ নিতেই অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ এখন রীতিমতো ভয়াবহ আকার নিয়েছে। আর এই সংঘর্ষে ব্যবহৃত হচ্ছে না কোনো সাধারণ অস্ত্র। এলাকার উঠতি কিশোর থেকে শুরু করে বড় শীর্ষ সন্ত্রাসী-সবার হাতেই শোভা পাচ্ছে বিদেশি পিস্তল, রাইফেল, শাটারগানসহ নানা অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। অবৈধ অস্ত্রের এই ভয়াবহ বিস্তার আর সহজ লভ্যতায় সাধারণ মানুষ আজ চরমভাবে আতঙ্কিত। কখন কার উপর কী বিপদ নেমে আসে, সেই ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে খুলনার প্রতিটি পরিবার।
**পুলিশের তথ্য ও চিত্র**
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) তথ্য এই ভয়াবহ পরিস্থিতিকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের একই সময় পর্যন্ত শহরে ৪৫টি হত্যা মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। এই সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ, যা উদ্বেগজনক হারে অপরাধ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। এইসব ঘটনায় জড়িত দেড়শ’র বেশি আসামিকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হলেও, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এছাড়াও উদ্ধার হয়েছে দুটি রাইফেল, পাঁচটি বিদেশি রিভলভার, ১৭টি বিদেশি পিস্তলসহ অন্যান্য আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, যা প্রমাণ করে অপরাধীদের হাতে কতটা আধুনিক এবং মারণঘাতী অস্ত্র পৌঁছেছে।
**করণীয় কী?**
খুলনার এই পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। মাদকের মরণছোবল এবং এর বাজার দখলের রক্তক্ষয়ী লড়াই একটি শান্ত শহরকে চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। শুধুমাত্র আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সচেতনতা বৃদ্ধি, যুবসমাজকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনা, এবং মাদকের উৎস ও সরবরাহ চেইন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা অত্যাবশ্যক।
অন্যথায়, খুলনা সত্যিকারের অর্থে ‘শান্ত’ খুলনা হিসেবে ফিরতে পারবে না, বরং থাকবে মাদকের ভয়ংকর নেশা আর অস্ত্রের ঝনঝনানির আড়ালে এক বিভীষিকাময় নগরী হিসেবে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে, সবার আগে প্রয়োজন মাদকমুক্ত খুলনার জন্য একটি সর্বাত্মক সামাজিক আন্দোলন।



