## ইসলাম ও প্রচলিত গণতন্ত্র: এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
“গণতন্ত্র” নামটা কানে এলেই আমাদের মাথায় চট করে একটা কথা চলে আসে। কবি ইকবালের সেই বিখ্যাত লাইনটা: ‘জামহুরিয়্যাত এক তর্জ-এ-হুকুমাত হ্যায় কে জিস মেঁ বান্দোঁ কো গিনা কারতে হ্যাঁয়, তোলা নাহিঁ কারতে।’ অর্থাৎ, “গণতন্ত্র হলো এমন এক শাসন, যেখানে লোকেদের শুধু গোনাই হয়, ওজন করা হয় না।”
এই কথাটার সহজ মানে হলো, কে বিদ্বান আর কে বোকা, কে জ্ঞানী আর কে মূর্খ—গণতন্ত্রে সব এক পাল্লায় মাপা হয়। এই কথাটা শুনতে শুনতে আমাদের কানে একদম পোকা ধরে গেছে। আমরাও না বুঝেই ধরে নিয়েছি, তাই তো! কথাটা তো খাঁটি। কিন্তু সত্যি বলতে কী, এই কথার মধ্যে সত্যির চেয়ে ভেজালই বেশি।
**গণতন্ত্র কি শুধু মাথা গোনে, নাকি ওজনও করে?**
এটা ঠিক যে গণতন্ত্রকে বলা হয় ‘জনপ্রতিনিধিদের শাসন’, কিন্তু তার মানে এই নয় যে দেশের সব কাজকারবার, সব প্রতিষ্ঠান শুধু মাথা গুনেই চলে। ব্যাপারটা মোটেও এমন নয় যে লোকেদের কেবল ‘গোনা’ হয়। আসলে, গণতন্ত্রের আসল বৈশিষ্ট্য হলো—এখানে ঠিক ঠিক ‘ওজন’ করা হয়। জ্ঞান, বুদ্ধি, যোগ্যতা আর কাজের দক্ষতা দেখেই লোকেদের বড় বড় দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ভেবে দেখুন, স্কুলের মাস্টারমশাই বা হেডস্যার, হাসপাতালের ডাক্তার, কোর্টের উকিল বা জজসাহেব, কিংবা ধরুন দেশের সেপাই—এঁদের কি আমরা ভোট দিয়ে ঠিক করি? নাকি তাঁদের পড়াশোনা, যোগ্যতা আর পরীক্ষা দেখে বাছা হয়? ঠিক তাই। দেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেই চলে যোগ্যতার মাপকাঠি।
**গণতন্ত্র: লক্ষ্য নয়, লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায়**
এখানে একটা জরুরি কথা আগেভাগে বুঝে নেওয়া দরকার। গণতন্ত্র কিন্তু নিজেই একটা মস্ত বড় ‘লক্ষ্য’ বা ‘মূল্যবোধ’ নয়। আসল লক্ষ্য বা মূল্যবোধ কী? আসল লক্ষ্য হলো—সবাই লেখাপড়া শিখবে, দেশে সুবিচার থাকবে, কেউ অনাহারে থাকবে না, সবাই নিরাপদে থাকবে, দেশের উন্নতি হবে।
গণতন্ত্র হলো সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটা ‘রাস্তা’ বা ‘উপায়’ মাত্র। ঠিক যেমন অতীতে খিলাফত ছিল একটা উপায়, রাজতন্ত্রও ছিল একটা উপায়। আর অন্য উপায়গুলোর যেমন ভালো-মন্দ ব্যবহার হয়েছে, লোকে সেগুলোকে খারাপ কাজে লাগিয়েছে, গণতন্ত্রেরও ঠিক সেভাবেই অপব্যবহার হতে পারে।
**ক্ষমতার ভাগাভাগি: জুলুমের বিরুদ্ধে এক সুরক্ষা বেষ্টনী**
আগেকার দিনে রাজা-বাদশাদের হাতে সব ক্ষমতা থাকত। তাঁরা যা বলতেন, তা-ই হতো। তাঁরা যা খুশি তাই করতেন। এতে দুনিয়ায় জুলুম আর অবিচার ছেয়ে গিয়েছিল। এই জুলুম বন্ধ করার জন্যই গণতন্ত্রের কারিগররা ভাবলেন, একটা নতুন ব্যবস্থা দরকার।
তারা ঠিক করলেন, কোনোমতেই সব ক্ষমতা এক জায়গায় বা একজনের হাতে রাখা যাবে না। ক্ষমতাকে অবশ্যই ভাগ করে দিতে হবে। তাই তাঁরা ক্ষমতাকে তিন ভাগে ভাগ করলেন—
১. **আইন বিভাগ:** যারা দেশের জন্য আইন বানাবে।
২. **নির্বাহী বিভাগ:** যারা সেই আইন মেনে দেশ চালাবে।
৩. **বিচার বিভাগ:** যারা আইন ভাঙলে বিচার করবে।
গণতন্ত্রে ঠিক কার হাতে ‘আসল’ ক্ষমতা, সেটা কিন্তু একটা ভারি মজার ধাঁধা। যেন একটা ‘গোপন রহস্য।’ কিন্তু ক্ষমতাকে যে এভাবে তিন টুকরো করে দেওয়া হলো, এটাই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় কেরামতি—একজনের হাতে লাগামহীন ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়ার পথ বন্ধ করা।
**গণতন্ত্রের দুর্বলতা সারানোর দাওয়াই: উচ্চ কক্ষের ভূমিকা**
আগেই বলেছি, কবি ইকবাল গণতন্ত্রের যে খুঁতটার কথা বলেছিলেন—যেখানে শুধু মাথা গোনা হয়, সেই খুঁতটা কিন্তু আসলেই আছে। কোথায় আছে? ওই যে আইন বানানোর জন্য লোক বাছা হয় (যাকে আমরা নিম্ন কক্ষ বা সংসদ বলি), সেখানে। ওই ভোটে সবার দাম সমান। একজন মস্ত বড় জ্ঞানী লোকের ভোটের যে দাম, একজন কিছুই না জানা লোকের ভোটের দামও ঠিক তা-ই। এটা গণতন্ত্রের একটা দুর্বলতা, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু যারা গণতন্ত্রের এই নকশা এঁকেছিলেন, তাঁরা কি এই দুর্বলতা জানতেন না? বিলক্ষণ জানতেন। আর তাই এই দুর্বলতা কাটানোর জন্য তাঁরা একটা দাওয়াইও বের করলেন।
তাঁরা শুধু ‘নিম্ন কক্ষ’ রেখেই ক্ষান্ত হননি, তার সাথে জুড়ে দিলেন একটা ‘উচ্চ কক্ষ’। নিম্ন কক্ষে কারা? জনগণের সরাসরি ভোটে জিতে আসা প্রতিনিধিরা। তাঁরা যে আইন বানানোর ওস্তাদ হবেন, এমন কোনো কথা নেই। তাঁরা হয়তো দেশের ভালো চাইতে গিয়ে আবেগের বশে এমন আইন করে বসতে পারেন, যা দেশের জন্য আসলে ক্ষতিকর।
তাহলে উচ্চ কক্ষে কারা? সেখানে থাকবেন দেশের বাঘা বাঘা বিশেষজ্ঞরা। বড় বড় আইন পণ্ডিত, অর্থনীতির সমঝদার, শিক্ষাবিদ, আর দেশের জ্ঞানীগুণী মানুষেরা।
আইন বানানোর খেলাটা হয় এরকম—
১. প্রথমে নিম্ন কক্ষে একটা আইনের প্রস্তাব (বিল) আনা হয়।
২. সেটা নিয়ে খুব আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়। সবাই সময় নিয়ে বোঝে, বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে।
৩. তারপর ভোট হয়। পাশ হলে সেটাকে পাঠানো হয় উচ্চ কক্ষে।
৪. উচ্চ কক্ষের বিশেষজ্ঞরা তখন ওই বিলটাকে কাটাছেঁড়া করেন। দেখেন, সব ঠিক আছে কি না।
৫. তাঁরা হয়তো সেটাকে ‘পাশ’ করে দিলেন, অথবা ‘আপত্তি’ জানিয়ে ফেরত পাঠালেন।
৬. নিম্ন কক্ষ তখন সেই আপত্তিগুলো নিয়ে আবার ভাবে।
৭. ভেবেচিন্তে যদি তারা আবার বিলটা পাশ করে, সেটা আবার উচ্চ কক্ষে যায়।
৮. উচ্চ কক্ষ কিন্তু এরকম দুই-দুবার বিল ফেরত পাঠাতে পারে।
৯. কিন্তু তৃতীয়বার যদি নিম্ন কক্ষ আবার ওটা পাশ করে পাঠায়, তখন উচ্চ কক্ষ সেটাকে আটকাতে পারে না, পাশ করে দিতে বাধ্য হয়।
১০. সবশেষে দেশের প্রধান সই করলেই সেটা পাকা আইন হয়ে যায়।
এভাবেই উচ্চ কক্ষ, গণতন্ত্রের “মাথা গোনার” দুর্বলতাকে “ওজন করার” মাধ্যমে পূরণ করে।
**ইসলাম ও গণতন্ত্র: সংঘাত এবং সমন্বয়ের পথ**
গণতন্ত্রের প্রায় সবকিছুর সাথেই ইসলামের মিলমিশ আছে, শুধু একটা জায়গা ছাড়া। এই একটা জায়গাতেই যত গোলমাল। গোলমালটা হলো—ইসলামে আইন বানানোর (শরিয়ত দেওয়ার) একচ্ছত্র অধিকার শুধু আল্লাহর। কোরআন আর সুন্নাহর বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে আইন বানানোর ক্ষমতা কোনো মানুষ বা প্রতিষ্ঠানের নেই।
তাহলে উপায়? উপায় হলো, ওই যে নিম্ন কক্ষ (সংসদ), তাদের ক্ষমতাকে একটু ঠিকঠাক করে নেওয়া। তাদের দুটো জিনিস পরিষ্কারভাবে আলাদা করতে হবে—
১. যেসব বিষয়ে ধর্মে সবাই একমত (মাজমা আলাইহ বা প্রতিষ্ঠিত শরিয়া আইন)
২. যেসব বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে (মুখতালাফ ফিহ বা ইজতিহাদের ক্ষেত্র)
যেসব বিষয়ে মতভেদ আছে, সেগুলোতে সংসদ আলোচনা করে দেশের জন্য যেটা ভালো, সেই মতটা বেছে নিতে পারে। কিংবা দেশের সাধারণ মানুষের উপকারের জন্য (মাসালিহ আম্মাহ) কোনো প্রশাসনিক নিয়মকানুন জারি করতে পারে। যদি নিম্ন কক্ষের ক্ষমতাকে এভাবে কোরআন-সুন্নাহর গণ্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলা যায়, তাহলেই গণতন্ত্রের আপত্তিকর দিকটা আর থাকে না।
কিন্তু এই জিনিসটা ঠিকঠাক কাজ করার জন্য দুটো বড় শর্ত আছে—
এক. **বিচার বিভাগকে হতে হবে পুরোপুরি স্বাধীন।** কেউ যেন তাদের কাজে নাক গলাতে না পারে। বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকলেই কোরান-সুন্নাহর সর্বোচ্চ ক্ষমতা অটুট থাকবে। আর এটাই ইসলামী ব্যবস্থার আসল ভিত্তি।
দুই. ওই যে **উচ্চ কক্ষটা আছে, সেখানে অন্য বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি অনেক আলিম, ফকিহ (ইসলামী আইনবিদ) আর মুহাদ্দিসদের (হাদিসবিদ) রাখতে হবে।** তাঁদের জ্ঞান আর প্রজ্ঞা শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে আইন প্রণয়নে সঠিক দিকনির্দেশনা দেবে।
এভাবে, প্রচলিত গণতন্ত্রের কাঠামোকে ইসলামের মৌলিক নীতির সাথে সমন্বয় সাধন করে এক ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।


