দীর্ঘ ২ বছর ধরে চলা ভয়ংকর আগ্রাসন এবং গণহত্যার পর অবশেষে গাজা উপত্যকায় দেখা যাচ্ছে একটি পরিবর্তনের আভাস। ইসরায়েলি বাহিনী উপত্যকাটির কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে। এই সংবাদ একদিকে যেমন কিছুটা স্বস্তির শ্বাস এনেছে, অন্যদিকে উপত্যকার মানুষজন যখন তাদের নিজেদের ভিটেমাটিতে ফিরছেন, তখন তারা দেখছেন কেবল ধ্বংসস্তূপ আর প্রিয়জন হারানোর নিদারুণ বেদনা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই সেনা প্রত্যাহার করা হচ্ছে, যা মোট ৩ ধাপে সম্পন্ন হবে বলে জানানো হয়েছে। তবে এই প্রত্যাহারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে কড়া শর্ত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, সেনা প্রত্যাহার করা হলেও গাজার ৫০ শতাংশেরও বেশি এলাকা ইসরায়েলি সেনাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। অর্থাৎ, কার্যত গাজার মানুষ তাদের ভূমির একটি বৃহৎ অংশের ওপর ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ বহাল দেখবে।
গাজার বাসিন্দারা স্থানীয় সংবাদদাতাদের জানিয়েছেন যে, ইসরায়েলি বাহিনী গাজা সিটির উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত থেকে পূর্ব দিকে সরে গিয়েছে। ইসরায়েলি গণমাধ্যমও নিশ্চিত করেছে যে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) গাজা উপত্যকার কিছু অংশ থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক মুখপাত্র আরও স্পষ্ট করে বলেছেন যে, সেনারা এমন সব স্থানে ফিরে যাবে যেখানে ইসরায়েলের গাজা উপত্যকার প্রায় ৫৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেও এক পোস্টে এই সেনা প্রত্যাহারকে একটি ‘নির্ধারিত সীমারেখা’ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন। গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউস একটি মানচিত্র প্রকাশ করে জানিয়েছিল, হলুদ রেখা দিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের প্রাথমিক প্রত্যাহারের সীমারেখা দেখানো হয়েছে। এটি তিন ধাপের সেনা প্রত্যাহারের প্রথম ধাপ।
তবে এই আংশিক সেনা প্রত্যাহারের খবরে যে শান্তি বা স্বস্তি আসার কথা, তা ম্লান হয়ে যায় গত দুই বছরের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের কথা মনে পড়লে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলায় গাজায় ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার আহত হয়েছেন।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য আরও মর্মান্তিক। এ যুদ্ধে ২০ হাজারের বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ৪২ হাজারের বেশি শিশু; যাদের মধ্যে অন্তত ২১ হাজার শিশু স্থায়ীভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এই পরিসংখ্যানগুলো শুধু সংখ্যা নয়, প্রতিটি সংখ্যা একজন হারানো জীবন, একটি ভাঙা পরিবার, একটি বিধ্বস্ত ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি। মানুষ যখন তাদের নিজ ভূমিতে ফিরছে, তখন তারা দেখছে কেবল ধ্বংসস্তূপ আর প্রিয়জন হারানোর বেদনা। নিজেদের ঘর-বাড়ি, স্কুল-হাসপাতাল – সবকিছুই পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।
ইসরায়েলি সেনাদের আংশিক প্রত্যাহার গাজার মানুষের জন্য এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে এসেছে। একদিকে যেমন যুদ্ধ কিছুটা স্তিমিত হওয়ার একটি ক্ষীণ আশা, অন্যদিকে নিজেদের ভূমির বৃহৎ অংশ হারানো এবং দীর্ঘমেয়াদী নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ। এই ‘শান্তি পরিকল্পনা’ কতটা শান্তি আনবে, নাকি শুধু একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে যেখানে গাজার মানুষজন তাদের নিজস্ব ঘরেই পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকবে, তা সময়ই বলবে। ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিলিস্তিনিদের ঘুরে দাঁড়ানোর এই কঠিন সংগ্রামে বিশ্ববাসীর নজর ও সমর্থন একান্ত প্রয়োজন।



