শহীদ আবরার ফাহাদ, একটি নাম যা কেবল বুয়েট নয়, গোটা জাতিকে এক গভীর বেদনায় আবদ্ধ করে রেখেছে। ২০১৯ সালে আগ্রাসী শক্তির হাতে অন্যায়ভাবে প্রাণ হারানো এই মেধাবী শিক্ষার্থীর স্মৃতি ও আত্মত্যাগের মহিমাকে ধারণ করে, সম্প্রতি বুয়েট সংলগ্ন পলাশী গোলচত্বরে উদ্বোধন করা হয়েছে ‘আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভ’। গত মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) এক আবেগঘন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই আট স্তম্ভের শুভ উদ্বোধন করা হয়।
এই আট স্তম্ভ কেবল একটি স্মারক নয়, বরং দেশের সার্বভৌমত্ব, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং গণমানুষের অধিকারের প্রতি এক দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রতীক। এটি আবরার ফাহাদের চেতনারই এক মূর্ত প্রকাশ, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্যায় ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)-এর দেওয়া তথ্য অনুসারে, আগ্রাসনবিরোধী এই আটটি স্তম্ভ আটটি গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক বিষয়কে নির্দেশ করে, যা একটি স্বাধীন ও সমৃদ্ধ জাতির জন্য অপরিহার্য:
১. সার্বভৌমত্ব
২. গণতন্ত্র
৩. গণপ্রতিরক্ষা
৪. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
৫. অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা
৬. দেশীয় শিল্প-কৃষি-নদী-বন-বন্দর রক্ষা
৭. সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা
৮. মানবিক মর্যাদাএই প্রতিটি বিষয়ই দেশের অখণ্ডতা, জনগণের অধিকার এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি। স্তম্ভগুলো যেনো প্রতিটি নাগরিককে এসব মূল্যবোধ রক্ষায় সজাগ থাকার আহ্বান জানাচ্ছে।উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া আট স্তম্ভের গভীর তাৎপর্য তুলে ধরে বলেন, “আট স্তম্ভের অবয়বের চেয়ে, আট স্তম্ভে লিখে রাখা বিষয়গুলো অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই শব্দগুলোর বাস্তবায়নের মাধ্যমেই এই বদ্বীপের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হবে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, ফ্যাসিবাদের সময়ে হাজার-হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখার বিভিন্ন ভাস্কর্য-প্রকল্প নির্মিত হলেও ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির পক্ষে সামান্য কিছু করলেই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়। অথচ এই আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভ নির্মাণে মাত্র ৩৯ লাখ ৫৯ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে, যা এর উদ্দেশ্য ও তাৎপর্যের তুলনায় খুবই নগণ্য।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী তাঁর বক্তব্যে আবরার ফাহাদের স্মৃতিকে ‘ঘরে-ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করবে’ বলে জানান। তাঁর এই ঘোষণা আবরার ফাহাদের আদর্শকে দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার সরকারি অঙ্গীকারের প্রতিধ্বনি।
ডিএসসিসি প্রশাসক জনাব মো. শাহজাহান মিয়া আবরার ফাহাদকে কেবল একজন ব্যক্তি হিসেবে নয়, ‘একটি চেতনা, একটি আদর্শ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি আরও বলেন, “আবরার ফাহাদ ২০১৯ সালে যে বীজ বপন করেছিলেন, সেটি একটি মহীরুহ হয়ে ২০২৪ সালের ৩৬ শে জুলাইয়ে পরিণত হয়েছে।” ডিএসসিসি প্রশাসক জানান, আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদের উদ্যোগ এবং স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার পরামর্শক্রমে ডিএসসিসি এই স্তম্ভ নির্মাণ করেছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তব্য রাখেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম, বুয়েটের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী, জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তবে এই আয়োজনে বিশেষ গুরুত্ব পায় শহীদ আবরার ফাহাদের পিতা মো. বরকত উল্লাহ এবং তাঁর ভাই আবরার ফাইয়াজের উপস্থিতি, যা এই স্মারক স্তম্ভের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে এবং উপস্থিত সকলের মাঝে এক গভীর আবেগ তৈরি করে।
পলাশীতে স্থাপিত এই আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভ কেবল আবরার ফাহাদের প্রতি একটি শ্রদ্ধা নিবেদন নয়, এটি অন্যায় ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর একটি প্রতীক। এই স্তম্ভগুলো দেশের যুবসমাজকে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব ও মানবিক মূল্যবোধ রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করবে, যা আবরারের আত্মত্যাগের মূল বার্তা। আবরার ফাহাদ বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে, তাঁর আদর্শ বেঁচে থাকবে এই আট স্তম্ভের প্রতিটি উচ্চারিত শব্দে।



